
প্রাচীনকাল থেকে নিম গাছ (Azadirachta indica) উপমহাদেশের ঐতিহ্য ও জীবনধারার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এটি শুধুমাত্র একটি ঔষধি গাছ নয়, বরং পরিবেশবান্ধব কৃষি, প্রাকৃতিক চিকিৎসা, খাদ্য সংস্কৃতি এবং টেকসই জীবনের এক অনন্য নিদর্শন।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নিম গাছকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বর্তমান সময়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তন, রাসায়নিক নির্ভরতা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিরুদ্ধে লড়াই চলছে—তখন এই গাছ যেন এক সবুজ আশ্রয়।
প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিম
চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতা-সহ বহু প্রাচীন আয়ুর্বেদিক গ্রন্থে নিম গাছের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। সংস্কৃত ভাষায় একে ‘নিম্ব’ বলা হয়, যার অর্থ ‘সুস্বাস্থ্য দানকারী’। মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষেও নিম পাতার ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে—যা প্রমাণ করে এটি হাজার বছরের মানবসভ্যতার অংশ।
পরিবেশবান্ধব ও বহুমুখী বৃক্ষ
নিম একটি চিরহরিৎ ও বহুবর্ষজীবী গাছ, যা প্রায় সব ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে। কালো দোআঁশ বা লবণাক্ত মাটিতেও এটি বেড়ে ওঠে। উচ্চতায় এটি ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং কাণ্ডের ব্যাস হয় ২০-৩০ ইঞ্চি।
এই গাছ স্বল্প রক্ষণাবেক্ষণে বাঁচে, তীব্র খরা সহ্য করতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও রাখে।
আধুনিক বিজ্ঞান কী বলছে?
নিম গাছে Nimbin, Nimbidin, Azadirachtin, Gedunin প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক গুণে সমৃদ্ধ। বর্তমানে এগুলো ব্যবহার হচ্ছে:
- ত্বকের সমস্যা: চুলকানি, ফাঙ্গাল সংক্রমণ, সোরিয়াসিস
- দাঁতের যত্নে: নিম ডাল জীবাণুনাশক টুথস্টিক হিসেবে কাজ করে
- পাচনতন্ত্রে: কৃমিনাশক ও হজমে সহায়ক
- ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: নিম পাতা বা রস ব্যবহৃত হয়
খাদ্য সংস্কৃতিতে নিম
বাঙালি রান্নায় নিম বেগুন ভাজা, নিম পাতার চাটনি, বা বেসনে নিম বড়া অত্যন্ত জনপ্রিয়। দক্ষিণ ভারতে ‘উগাদি পাচাদি’ নামের এক ঐতিহ্যবাহী রন্ধনপ্রণালীতে নিম ফুল ব্যবহার হয়। তামিলনাড়ুর ‘ভেপ্পাম পু চাউ’ ও ভিয়েতনামের ‘গই সাউ ডাউ’ সালাদে নিম ফুল ব্যবহৃত হয়।
কৃষিতে বিপ্লব এনেছে নিম
নিম তেল হলো একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক কীটনাশক, যা রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
নিম কেক মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। বিশেষ করে জৈব কৃষির ক্ষেত্রে নিমের গুরুত্ব দ্রুত বাড়ছে।
কাঠ ও রপ্তানি সম্ভাবনা
নিম কাঠ মজবুত ও টেকসই। আসবাবপত্র নির্মাণে এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নিম-ভিত্তিক প্রসাধনী ও চিকিৎসা পণ্যের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে।
UNEP-এর এক্স (পূর্বে টুইটার) হ্যান্ডলে উল্লেখ করা হয়:
"The Neem tree is truly an agro-scientific celebrity and has been declared the ‘Tree of the 21st Century.’”
নিম গাছ কেবল একটি ঔষধি গাছ নয়, এটি এক সবুজ জীবনদর্শন। প্রাকৃতিক জীবনধারা, জৈব কৃষি এবং বিকল্প চিকিৎসার যাত্রাপথে এটি একটি অনিবার্য সঙ্গী।
আজ যখন আমরা আবার প্রকৃতির দিকে ফিরছি, তখন নিম যেন আমাদের সেই পুরনো বন্ধুর মতো ফিরে এসেছে—নতুন বিজ্ঞান আর পুরনো বিশ্বাসের সেতুবন্ধনে।