
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি একটি নতুন তালিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে সাতটি দেশকে ‘নিরাপদ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে—তাদের মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। এই তালিকায় আরও রয়েছে: কসোভো, কলম্বিয়া, মিশর, ভারত, মরক্কো এবং তিউনিসিয়া।
এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—এই দেশগুলো থেকে যেসব মানুষ ইউরোপে আশ্রয় চায়, তাদের আবেদন যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতে, এসব দেশের মানুষ সাধারণত প্রকৃত বিপদের মুখে পড়েই ইউরোপে আসছে না।
বাংলাদেশের আবেদনকারীদের জন্য কী মানে এটা?
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অভিবাসনের চেষ্টা নতুন নয়। অনেকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক কারণে ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন করে থাকেন। ইউরোপীয় তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৪৩ হাজার বাংলাদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু সফলতার হার খুবই কম—শুধুমাত্র ৩.৯৪ শতাংশ।
অর্থাৎ প্রায় ৯৬ শতাংশ আবেদন-ই খারিজ হয়ে যাচ্ছে। এবার এই নতুন ‘নিরাপদ দেশ’ ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য সংকেত দিচ্ছে—এখন থেকে এসব আবেদন আরও দ্রুত এবং কঠোরভাবে খতিয়ে দেখা হবে এবং তিন মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।
আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সময় সংকুচিত হচ্ছে
আগে আশ্রয় আবেদনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় নিয়ে হত, ফলে আবেদনকারীরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ করে কিছুটা স্থিতি পেতে পারতেন। এখন, যেহেতু ‘দ্রুত প্রক্রিয়া’ চালু হচ্ছে, বাংলাদেশিদের জন্য ইউরোপে গিয়ে দীর্ঘ সময় থাকা, কাজ খোঁজা বা আবেদন জিইয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞ শরীফুল হাসান বলছেন, “এটি সত্যিকারের বিপদে থাকা মানুষের জন্য আশ্রয় পাওয়া কঠিন করে তুলবে।” তিনি আরও বলেন, “যারা কেবল অর্থনৈতিক সুযোগের আশায় যাচ্ছেন, তাদের আবেদনগুলোই হয়তো এই দ্রুত নিষ্পত্তির আওতায় বেশি পড়বে।”
কেন এই সিদ্ধান্ত?
২০১৫-১৬ সালে ইউরোপে অভিবাসনের ঢল শুরু হওয়ার পর থেকেই আশ্রয় নীতিতে পরিবর্তনের দাবি বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালে প্রায় ৩.৮ লাখ মানুষ ইউরোপের সীমান্তে প্রবেশ করেন, যাদের অনেকেই অবৈধভাবে এসেছেন। এর প্রেক্ষিতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি নতুন ‘অভিবাসন ও আশ্রয় নীতি’ গঠন করে, যা ২০২৬ সালে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তারা এখন থেকেই কিছু দিক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
এরমধ্যে রয়েছে:
১) যেসব দেশের আবেদনকারীদের সফলতার হার ২০ শতাংশের কম, তাদের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।
২) যেসব দেশকে ‘নিরাপদ’ হিসেবে ধরা হচ্ছে, সেসব দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য কঠোর প্রক্রিয়া চালু করা হবে।
বাংলাদেশিরা কোন পথে যাচ্ছে?
বিশেষ করে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে যাওয়ার রুটে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি বাড়ছে। ২০২১ ও ২০২৪ সালে এই পথে যাওয়া শীর্ষ কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম।
ইতালি, জার্মানি ও গ্রীসের মতো দেশে এরা আবেদন করে থাকেন। এখন নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যদি বাংলাদেশের মতো দেশকে 'নিরাপদ' ধরা হয়, তবে সেখানে থেকে আসা মানুষদের রাজনৈতিক বা মানবিক আশ্রয়ের আবেদনের সম্ভাবনা কমে যাবে।
তালিকা নিয়ে বিতর্ক ও উদ্বেগ
ইতালির ডানপন্থি সরকার ইতোমধ্যে এ তালিকাকে স্বাগত জানালেও, অনেক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এসব দেশের মধ্যে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও আছে। তাই সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ বলা যুক্তিসংগত নয়।
ইউরোপীয় কমিশন যদিও বলছে, প্রতিটি আবেদন আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আবেদনকারীদের একটি বড় অংশ অগ্রিমই খারিজ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশিদের জন্য করণীয় কী?
এই পরিস্থিতিতে যারা ইউরোপে যাওয়ার চিন্তা করছেন, বিশেষ করে সমুদ্রপথ বা অবৈধ পথে, তাদের জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে এই সিদ্ধান্ত। একইসঙ্গে যারা সত্যিকারের বিপদের কারণে আশ্রয়ের দরকার তাদের জন্যও এই তালিকা কঠিন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন প্রয়োজন বৈধ উপায়ে অভিবাসনের চেষ্টা করা, আর সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে নাগরিকদের সঠিক তথ্য দেওয়া উচিত।