
বিডিআর-বিএসএফ মধ্যকার সে সংঘর্ষ 'বড়াইবাড়ি যুদ্ধ' নামে পরিচিত স্থানীয়দের কাছে। নিহত বিডিআর সদস্যদের স্মরণে সেখানে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।
২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত সীমান্তগ্রাম কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়িতে ভোরের ঘুম ভেঙে আসে গোলাগুলির গর্জনে। ওই দিন সূর্য ওঠার আগেই ঘটেছিল দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে এক নজিরবিহীন সংঘর্ষ—যেখানে সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।
ভারতীয় বাহিনীর অনুপ্রবেশ ও উত্তেজনার সূত্রপাত
সেই দিন ভোর রাতে বড়াইবাড়ি গ্রামের কয়েকজন কৃষক তাদের জমিতে সেচের জন্য গেলে চোখে পড়ে অস্ত্রধারী শতাধিক সৈন্য। হিন্দিতে কথা বলা সেই সেনাদের প্রশ্নে বোঝা যায়, তারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্য। তারা ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। দ্রুত খবর যায় বড়াইবাড়ি বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্পে। তখন ক্যাম্পে ছিলেন মাত্র ৮ জন বিডিআর সদস্য।
প্রতিরোধের জন্য সংগঠিত মানুষ ও বাহিনী
বিডিআরের পাশাপাশি গ্রামের আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য এবং স্থানীয়দের নেতৃত্বে এক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তখনকার স্থানীয় নেতা রুহুল আমিন জানান, গ্রামবাসী পালিয়ে গেলেও পরে ফিরে এসে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াইয়ে যোগ দেন।
রক্তাক্ত সংঘর্ষ: সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের দিন
ভোর পাঁচটা থেকে সকাল এগারোটা পর্যন্ত বড়াইবাড়িতে চলে তীব্র গোলাগুলি। আটজন বিডিআর সদস্য প্রথম চার ঘণ্টা অদম্য সাহস নিয়ে লড়াই করেন। পরে আশেপাশের ক্যাম্প ও ময়মনসিংহ-জামালপুর থেকে আরও সদস্য এসে যোগ দেন।
এই সংঘর্ষে বিএসএফের ১৬ জন সদস্য নিহত হন। বাংলাদেশের দাবি ছিল, আরও অনেকে নিহত হয়েছিলেন কিন্তু তাদের দেহ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পটভূমি: সিলেটের পদুয়া থেকে রৌমারি পর্যন্ত উত্তেজনা
এই ঘটনার পেছনে ছিল পূর্বে সংঘটিত সিলেটের পদুয়া সীমান্তের উত্তেজনা। সেখানে ভারতের বিএসএফ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং রাস্তা নির্মাণ করতে থাকে। বিডিআর বাধা দিলে তা উপেক্ষা করে কাজ চালায় বিএসএফ। পরে বিডিআর সেখানে অপারেশন চালিয়ে পদুয়া পুনরুদ্ধার করে। সেই প্রতিশোধেই কুড়িগ্রামের রৌমারীর বড়াইবাড়িতে ঢুকে পড়ে বিএসএফ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক তৎপরতা
ঘটনার পর গণমাধ্যমে এক মৃত বিএসএফ সদস্যকে বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে করে নেয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়লে ভারতে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়ায়। শুরুতে তারা লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তা সমাধান হয়।
ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব একে ‘বর্বরতা’ বলেন, আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং বাংলাদেশকে কড়া বার্তা দেন। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আত্মরক্ষার জন্য বিডিআরের ভূমিকার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেন।
স্মরণে সাহসী সেই প্রতিরোধ
আজ এত বছর পরও বড়াইবাড়ির সেই প্রতিরোধ বাংলাদেশিদের মনে জায়গা করে রেখেছে ‘গর্ব ও সাহসের প্রতীক’ হিসেবে। ছোট একটি ক্যাম্পের কয়েকজন সৈনিক আর সাধারণ মানুষ কীভাবে মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সাহসিকতার অধ্যায়ে চিরস্মরণীয়।