
আমার স্ত্রী তমা। আমি আদর করে ডাকি প্রিয়তমা। কিন্তু সে শুধু আমারই প্রিয়তমা নয়। তাকে প্রিয়তমা বলে ডাকবার আরও একজন আছে।
তমা পেশায় একজন চিকিৎসক। বাসা থেকে খানিকটা দূরে একটা ক্লিনিকে চাকরি করছে। পাশাপাশি চেম্বারও করছে অন্য একটা জায়গায়। সাদা এপ্রোন পরে রোজ সকালে ডিউটিতে বেরিয়ে যায় সে। আমি দুই বছর ধরে তাইই জানতাম। কিন্তু সে আসলে ডিউটিতে যায় না। সে যায় তার আরেকটি সংসারে। আরেক জন পুরুষের কাছে।
ওদিকে একইভাবে সারাদিন ওই বাড়িতে সংসার শেষে সন্ধ্যাবেলায় নাইট শিফটের ডিউটির কথা বলে বাসা থেকে বেরোয়। আর আমার বাসায় আসে এমনভাবে যেন সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্তশ্রান্ত তমা বাসায় ফিরলো। আমি ওর অপেক্ষায় থাকি। এভাবেই কেটে গেছে আমাদের সংসারের দুইটা বছর। আমি বুঝিনি কখনও। ভাবিনি তমা এমন কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে। আমি তো ছিলাম ওর সবটুকু। অন্তত ওর রোমান্স, আমার প্রতি কেয়ারনেস আর সংসার সামলে নেয়ার দক্ষতা দেখে তা বোঝার উপায় ছিলো না।
ঘটনার শুরু সেদিন, যখন আমার এক বন্ধুর অসুস্থ স্ত্রীকে আমি ওর কাছে নিয়ে যেতে বলি। বন্ধু সেখানে গিয়ে তমাকে না পেয়ে জানায় তমা নাকি এখানে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বহু আগেই। কথাটা শুনে আমি অনেক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কিছু ভাব্বারও অবকাশ ছিলোনা। তমা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে অথচ আমাকে জানায় নি! তাহলে এখন কোথায় চাকরি করছে সে?
বিষয়টা তমার কাছেই জানতে চাইলাম। প্রথমে খানিকটা ইতস্তত বোধ করলেও পরে শুষ্ক হাসি দিয়ে বললো, "এখন অন্য একটা জায়গায় জব নিয়েছি।"
"আমাকে তো জানাও নি!"
"জানাই নি? কী বলো! আমার ক্লিনিকের পাশেই। তোমাকে জানিয়েছিলাম। মনে করে দেখো।"
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম না। কারণ এটা সে আমাকে জানালে স্পষ্ট মনে থাকতো আমার। তমার সঙ্গে আমার পরিচয় সে যখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সদ্য ঢাকায় এসেছে। চোখে সীমাহীন স্বপ্ন কিন্তু পরিবারের সাপোর্ট নেই। সত্যি বলতে সাপোর্ট করার কেউ ছিলোও না। তমার নিজের বলতে অসুস্থ মা ছাড়া কেউ ছিলো না।
আমি তখন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একটা প্রাইভেট ফার্মে জবে ঢুকেছি। আমাদের পরিচয়টা হয় খুব সাদামাটাভাবেই। তাকে দেখতাম হন্য হয়ে টিউশনি খুঁজতে। আমি বেশ কয়েকটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দেই। এরপর আমাদের কথা হতো প্রয়োজনে কিংবা হালকা খোঁজ খবর নেয়ার খাতিরে।
মেয়েটা বড্ড একা, এভাবে লড়ছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ওর পাশে থেকেছিলাম পুরোটা সময়। মেডিকেল ভর্তির প্রস্তুতিটাও আমিই তাকে নিতে উৎসাহ দেই। কখনো কথা দিয়ে, কখনোবা অর্থ দিয়ে তার পাশে ছিলাম সবসময়। তমা ছিলো মেধাবী, পরিশ্রমী। সেই তমা আমার চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হলো।
তার ডাক্তার হওয়া পর্যন্ত আমি কখনো বিয়ের কথা বলিনি। সে যখন পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে এলো, জীবনটা গুছিয়ে ফেললো বেশ। তবেই জানালাম এখন বিয়ের উপযুক্ত সময়।
সেই তমা কি এতকিছুর দায় শোধ করার খাতিরেই আমাকে ছেড়ে যেতে পারেনি!
এই শহরে আমার কেউ নেই। বয়স্ক বাবা মা আছেন, তারাও থাকেন গ্রামে। তমার কর্মস্থলে প্রথমদিকে যেতাম। একদিন সে ই নিষেধ করলো আমাকে, 'জহির, তুমি আমার অফিসে এসো না। তোমাকে দেখলে আমার কাজ করতে ভালো লাগে না। সব ছেড়ে ছুড়ে গৃহিণী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।'
আমি ওর কথাটাকে অত সিরিয়াসলি চিন্তা করিনি। তবে সত্যিই আর কখনো ওর ক্লিনিকে যাইনি। এদিকে সে সেখানকার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও সংসার গুছিয়েছে, তা আমার কল্পনারও বাইরে।
প্রতিদিন সকালে আমি নাস্তা বানাই। তমা খেয়েদেয়ে ডিউটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। ডিউটির পর চেম্বার শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ক্লান্ত মানুষ, ফিরবে বলে আমিই কিছু কাজ গুছিয়ে রাখি। কতবার বলেছি চাকরিটা ছাড়ো নয়তো চেম্বার। সে কোনোটাই ছাড়বে না। এগুলো নাকি তার অস্তিত্ব।
আমার জানা ছিলো না এই অস্তিত্বের সবকিছু ভুলে সে কার সংসারে সারাদিন আলো ছড়ায়।
সেদিন সন্ধ্যায় তমা এসেছিল একটু তাড়াতাড়ি। হাতে ব্যাগ, চোখে চেনা ক্লান্তি। আমি তখন কিচেনে, ওর জন্য পছন্দের মুগডাল রান্না করছিলাম। তমা পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো। বললো, "আজ একটু বসো তো আমার পাশে। কথা বলতে চাই।"
আমি হাত ধুয়ে এলাম। বসতেই তমা আমার দিকে একরকম ভয় মেশানো চোখে চেয়ে বললো, "জহির, তুমি কি কখনও ভেবেছো, ভালোবাসার জন্য মানুষ যেকোনো অন্যায় করতে পারে?"
আমি চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তমা হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বললো, "আমি চেয়েছিলাম বলবো সব... কিন্তু সাহস পাইনি। আমি দুটো জীবন বাঁচিয়ে চলেছি, আর এখন তাতে আমিই হারিয়ে যাচ্ছি..."
আমি তমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকে এই প্রথমবার এতটা অসহায়, ভীত দেখাচ্ছিল। গলার স্বর কাঁপছিল, চোখে জল টলমল। আমি কোনো কথা বলিনি। কেবল মাথা নেড়ে বললাম, "তুমি বলো তমা। সব বলো। কি অন্যায় করেছো তুমি?"
তমা একটু সময় নিলো। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "আমি তোমার ভালোবাসা আর যত্নের কাছে ঋণী ছিলাম সবসময়। কিন্তু মন থেকে ভালোবাসা বলতে যা বোঝায়, তা কখনো তোমার জন্য অনুভব করিনি। আমাকে তোমার খুব খারাপ মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কাছে আর কোনো পথ ছিলো না।"
তমা চোখ নামিয়ে ফেলে। আমি নিঃশব্দে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
ও বললো, "ওর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই আমি যেন দেহমনে ওর হয়ে যাই। ওকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারতাম না। কিছুদিন রিলেশন ছিলো। কিন্তু ও আমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত ছিলো না। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে যায়। তখনই তুমি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে। আমি কোনোকিছু না ভেবেই তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ভাবলাম জীবনটা তোমার সঙ্গেই সাজাবো।"
তমা খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বললো, "তোমার সঙ্গে বিয়ের পরে অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভালোবাসার। একদিন একা ছিলাম ক্লিনিকে, ও এসে দেখা করলো। কথার পর কথা। কখন যে আমি ওর প্রতি আবারও দূর্বল হয়ে পড়লাম আর কখন যে আমি আর শুধু তোমার তমা রইলাম না, তা নিজেও বুঝিনি।"
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তমা বলে যায়, "স্নিগ্ধ একা থাকতো, মা-বাবা নেই। ওর পাশে আমিই ছিলাম সব। কিছুদিন পর ও বলল, তুমি না থাকলে আমি আর বাঁচতে পারবো না। চলো বিয়ে করি। আমার মন গলে গেল। আমি যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে পেতে চাইছিলাম। ওর সঙ্গ চাইছিলাম। ও জানেনা আমি বিবাহিতা। আমরা লুকিয়ে বিয়ে করলাম। তুমি তখন কিছুই টের পাওনি। মনে আছে একবার একটা ট্রেনিংয়ের কথা বলে কিছুদিন বাহিরে গিয়েছিলাম? সেটা ছিলো স্নিগ্ধ আর আমার বিয়ের পরবর্তী কয়েকটা দিন। আমি ওর কাছেই ছিলাম। এরপর চাকরিটা ছেড়ে দেই। একসঙ্গে দুইটা সংসার চালিয়ে নেয়ার জন্য এছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিলো না। এভাবেই আমি নিজের জীবনের অর্ধেক টুকরো আলাদা করে ফেললাম, আর সেটা তোমার কাছে লুকিয়ে রাখলাম।"
আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না তমার কথা শুনে। এও কি বিশ্বাসযোগ্য? তাই বলে কখনোই আমি তার আচরণে কিছুই টের পাবো না? আমি কি এতটাই অথর্ব আর বোকা?
তমা এবার আমার হাত ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,"আমি জানি তুমি ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমি এতদিন ধরে চাইছিলাম, একদিন শুধু একজন না, দুইজনকেই সত্যিটা জানিয়ে ফেলি। আমি আর এই দুইখানা মুখে, দুইখানা সংসারে, দুইরকম মানুষ হয়ে বাঁচতে পারছি না।"
আমার বুকটা হালকা করে হুহু করে উঠলো। তমা এখন কাঁদছে। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছি না। আমার চোখ যেন পাথর।
তমা কান্না থামিয়ে একটু চুপ করে রইলো। আমি এখনও কোনো শব্দ করিনি। শব্দহীনতা মাঝে মাঝে সবচেয়ে বেশি কথা বলে।
সে উঠে দাঁড়াল, ঘরটায় হেঁটে বেড়ালো একটু। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "তুমি জানো, আমি আজও ঠিক বলতে পারি না আমি কারটা বেশি ভালোবাসি। কারণ আমি দুইজনের কাছেই আলাদা রকমভাবে সত্যি ছিলাম। তোমার কাছে আমি ছিলাম একজন প্রিয়তমা স্ত্রী। শান্ত ঘর, সন্ধ্যাবেলার চা, আর তোমার যত্ন। আর রাহাতের কাছে আমি ছিলাম হৃদয় উজাড় করা নারী যাকে সে ভীষণ রকম চায়। আমিও ওকে পেতে মরিয়া হয়ে ছিলাম।"
আমি এবার ধীরে ধীরে বললাম, "তুমি কি কখনও আমাদের কারও সঙ্গে বেঁচে থাকতে চাওনি পুরোপুরি?"
তমা একটু থমকে গেল। বলল, "চেয়েছিলাম। শুরুতে তোমাকেই চেয়েছি। এরপর স্নিগ্ধকে। যখন ওর সঙ্গে খানিকটা মনোমালিন্য হয়, তোমাকেই আপন করতে চেয়েছি। এভাবেই চলেছে এতগুলো দিন। কিন্তু বুঝতে পারিনি ভালোবাসার নামে কখন দুটো জীবন গেঁথে ফেলেছি আমি। এখন কিছু কাটতে গেলে, রক্ত ঝরবেই।"
আমি এবার উঠে দাঁড়ালাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালাম। রাতের আকাশে ঝাপসা লাগছে সব নক্ষত্র। তমা পেছনে এসে দাঁড়াল। বলল, "আমার ইদানীং আর ভালো লাগছে না এই মিথ্যা খেলা। অভিনয় আর ভান ধরতে ধরতে আমি ক্লান্ত। আমি আর পারছি না। তুমি যা ইচ্ছে বলো।"
আমি চুপ করে থাকলাম। কিছুই বলতে পারলাম না। মাথার ভেতরে বাজতে থাকলো পুরোনো সব স্মৃতি। তমার হাসি, আমার রান্নার পছন্দ, একসঙ্গে দেখা সিনেমা, আমার জন্মদিনে ওর পিঠে হাত রেখে বলা "ভালোবাসি"।
আমার মনে হলো, মানুষ শুধু প্রেমে পড়ে না, অভ্যেসেও পড়ে।আর অভ্যেস থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক কঠিন। ওর অভ্যাস থেকে আমি কিভাবে নিজেকে মুক্ত করবো?
আমি ধীরে ধীরে সাহস করে বললাম, "তুমি তার কাছে চলে যাও। আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম।"
তমা অনেক্ষণ চুপ। এই চুপচাপ মুহূর্তের ভেতরেই বুঝি আমাদের সংসারের শেষ সন্ধ্যা নেমে গেছে..